+8801303535373
No products in the cart.
“বাইবেলের সত্যকে বিকৃত করার অধিকার আপনার নাই,পোপ! ঈশ্বর যখন আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করেন, তখন ওরা ছিলো নগ্ন; আপনি তাদের কাপড় পরাতে পারেন না। বাইবেলের সত্যকে বিকৃত করলে আপনার পাপ হবে। অমার্জনীয় ও ঘোরতর পাপ। এবং এ পাপের দায়ে আপনি নরকে যাবেন। আপনি তাই চান পোপ?”
কথাটি রাফায়েলের চিত্রসংশোধনের সময় পোপকে বলেছিলেন মাইকেলেঞ্জেলো। উভয়েই ছিলেন চিত্রশিল্পী। গুরু ও শিষ্য।
সিক্সটাস দ্য ফোর্থ। ভ্যাটিকানের পোপ। নির্মান করেছেন একটি গির্জা। নিজ নামে। সিস্টাইন চ্যাপেল। নির্মান করেছিলেন ব্যক্তিগত উপাসনার জন্য। এবার এমন কিছু চিহ্ন-নিদর্শনের প্রয়োজন যে, এটা একটা উপাসনালয়। দরকার বাইবেল বর্ণিত কিছু চিত্র। দায়িত্ব দিলেন মাইকেলেঞ্জেলোকে। সমসাময়িক কালের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী তিনি। মাইকেলেঞ্জেলো বাইবেল বর্ণিত চিত্রগুলো সিস্টাইন চ্যাপেলেরর দেয়ালে আঁকতে শুরু করেন ফ্রেসকো স্টাইলে। ঈশ্বর কর্তৃক আদম-হাওয়ার সৃষ্টিকে চিত্রিত করতে গিয়ে মাইকেল আঁকেন তাদের নগ্ন-আদল।
কাজের এক পর্যায়ে মাইকেল হয়ে পড়েন অসুস্থ। প্রয়োজন পড়ে বিশ্রামের। বিশ্রাম নিতে থাকেন। ছেদ পড়ে যায় কাজে। পোপের আর তর সইছিলো না। মাইকেল আবার কবে সুস্থ হবেন কিংবা আদৌ সুস্থ হবেন কি নাবিষয়টি নিয়ে তুমুল অন্তর্দ্বন্দে দোলায়িত হতে থাকেন পোপ। বেশ উৎকণ্ঠায় সময় কাটতে থাকে তার। কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাড়নায় পোপ নিযুক্ত করেন রাফায়েলকে। তিনি তাঁরই ছাত্র। সেকালের আরেক সিদ্ধহস্ত চিত্রশিল্পী। গুরুমারা বিদ্যা ঝেড়ে রাফায়েলকে পোপ বোঝালেন : গির্জাকে অপবিত্র করে ফেলছে এইসব নগ্ন ছবি। ‘ওদের নগ্নতাকে ঢেকে দাওকাপড় পরিয়ে হোক কিংবা অন্য কোনো পন্থায়। রাফায়েলকে আদেশ করলেন পোপ। রাফায়েল আবৃত করার কাজ যথারীতি শুরু করে দিয়েছেন। খবর পৌঁছে মাইকেলের কাছে। তিনি রেগেই আগুন। ‘কত্ত বড় সাহস। আমার কাজে হাত দিয়েছে, আমার কাজকে বিকৃত করে’।অসুস্থ শরীরেই কাঁপতে কাঁপতে কম্বল মুড়িয়ে এসে চ্যাপেলে উপস্থিত হন অগ্নিশর্মা মাইকেল। তারই তৈরি কাঠের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাত চালাচ্ছেন মাইকেল ফ্রেসকো স্টাইলের ছবিতেএকটু ভদ্র করার মানসে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে রাফায়েলকে মাইকেল বললেন: ‘আমার ফিগারগুলোয় হাত দিবি না। বদমাশ, তুই নেমে আয়।’ উস্তাদের ধমকে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন রাফায়েল। নামতে বাধ্য হলেন। কম্বল ফেলে দিয়ে অসুস্থ শরীরেই মাইকেল উঠে যান তার প্ল্যাটফর্মে এবং কাজ শুরু করে দেন যথারীতি একজন সুস্থ ব্যক্তির মতই।একদম নির্বিকারে। রাফায়েলেরর কাছে খবর পেলেন পোপ। স্বয়ং এসে উপস্থিত হোন অকুস্থলে। তর্ক-বিবাদে লিপ্ত হোন মাইকেলের সাথে। পোপকে উদ্দেশ্য করে মাইকেল তখন বলতে থাকেন :’ বাইবেলের সত্যকে বিকৃত করার অধিকার আপনার নাই, পোপ! ঈশ্বর যখন আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করেন, তখন ওরা ছিলো নগ্ন। আপনি ওদের কাপড় পরাতে পারেন না। বাইবেলকে বিকৃত করলে আপনার পাপ হবে। অমার্জনীয় ও ঘোরতর পাপ। এবং এ পাপের দায়ে আপনি নরকে নিক্ষিপ্ত হবেন। আপনি কি তাই চান পোপ?” মাইকেলের কথা শোনে পোপের পিলে চমকে যায়। চক্রাকারে ঘুরতে থাকে তার মাথা। মাথা ঘুরছে না পৃথিবী ঘুরছে কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। ধর্মের হক-কাহিনী শোনার বকদের যেমন হয়ে থাকে আর কি। যথেষ্ট মগজ ধোলাই হলো তার। মাইকেলের কথা মত চিত্রগুলো নগ্নই থেকে গেলো। নগ্নতা রূপ নিলো একটা তত্ত্বে। নগ্নতার নন্দনতত্ত্বে। শিল্প-সাহিত্যে নগ্নতা নন্দনতত্ত্বের রূপ নিলো মাইকেলের সেই বক্তব্যের জের ধরে।
বার্নাবাসের অবিকৃত বাইবেল নগ্নতার তত্ত্বটিকে সমর্থন করতে পারলোনা। সমর্থন করতে পারলো না মাইকেলের স্বকপোলকল্পিত বক্তব্যকে। বার্নাবাসের বাইবেলের তথ্য মতে, সৃষ্টির পর মুহূর্তে আদম-হাওয়া বস্ত্রাবৃতই ছিলেন। তাদের বস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হয় সেব ও গন্ধম ভক্ষনের পর, সীমালঙ্ঘন করার কারণে। বার্নাবাসের বাইবেলে বিবরণটি যিশুখ্রিস্টের ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে যে, “আল্লাহ্ এই মানুষকে (আদম) নিঃসঙ্গ ও একাকী দেখে মন্তব্য করলেন যে, ‘এতো ঠিক নয় যে, সে একাকী থাকবে।’ আল্লাহ্ তাকে নিদ্রাভিভূত করলেন এবং হৃৎপিণ্ডের পাঁজরের একখানা হাড় খসিয়ে শূন্যস্থান মাংস দিয়ে পূরণ করে দিলেন। এই পাঁজরের হাড়েই তিনি তৈরি কররলেন হাওয়াকে এবং আদমকে দান করলেন স্ত্রী রূপে। এই দম্পতিকে জান্নাতের অধিকার দিয়ে বললেন, ‘দেখো, এখানকার সকল ফলমুল ভোগ করার অধিকার তোমাদের দেয়া হলো কেবল সেব ও গন্ধম ব্যতিত।’ অতঃপর তিনি আরো বললেন: ‘সাবধান! কোনোক্রমেই এই ফলদ্বয় ভক্ষণ করো না। করলে নাপাক হয়ে যাবে। এমনভাবে যে, আমি তোমাদের এখান থেকে তাড়াতে বাধ্য হবো। ফলত তোমরা নিপতিত হবে মহাদুর্ভোগে।”
“বিষয়টি অবগত হয়ে শয়তান রাগে-গোস্বায় উন্মাদ হয়ে গেলো। তাই সে একদিন জান্নাতের দ্বারদেশে উপনীত হয়ে দেখলো যে, এক ভয়াল দর্শন সাপ সেখানটায় পাহারারত। সাপটির পাগুলি উঠের পায়ের মতো, এবং পায়ের নখগুলি ক্ষুরের মতোই চারদিকে ধারালো। দুষ্ট শয়তান তাকে বললো, ‘আমাকে থোড়া বেহেশতের হাওয়া খেতে দাও ভাই’।
‘সাপ উত্তর দিলো, ‘আমি তোমাকে কী করে বেহহেশতে ঢুকতে দিই যখন স্বয়ং খোদাই হুকুম দিয়েছেন তোমাকে তাড়িয়ে দেবার জন্যে।’
‘শয়তান বললো, ‘তুমি কি দেখছো না আল্লাহ্ তোমাকে কতটুকু পছন্দ করেন যেখানে তোমাকে বেহেশতের বাইরে পাহারায় নিযুক্ত রাখা হয়েছে ঐ মাটির স্তুপের জন্য, যার নাম মানুষ? তাই যদি তুমি আমাকে বেহেশতে ঢুকিয়ে দাও তবে আমি তোমাকে এমন সাংঘাতিক কিছু বানাতে পারবো, যা দেখে তোমার কাছ থেকে সবাই পালিয়ে যাবে। যেমন খুশি তেমন চলতে পারবে। যথা ইচ্ছা তথা যেতে পারবে তখন।’
“সাপ প্রশ্ন করলো,’আমি কিভাবে তোমাকে ভেতরে নিতে পারবো?’ ” শয়তান বললো, ‘তুমি তো দেখছি সত্যিই মহান; তাহলে তুমি এক কাজজ করো- হা করো। আমি ঢুকে পড়ি তোমার পেটে। আমাকে তুমি সেখানে নিয়ে উগরে দেবে। যেখানে ঐ দুই মাটির ঢেলা বিচরণ করতে শুরু করেছে।’
সাপটি তখন তাই কররলো। হাওয়ার নিকটে নিয়ে তাকে উগরে ফেললো। আদম তখন সেখানে নিদ্রাগমন করেছিলেন। শয়তান হাওয়ার সামনে মনোহর ফেরেশতার রূপ ধরে দাঁড়ালো এবং বললো,’কি জন্যে তোমরা এই সেব ও গন্ধম খাচ্ছো না লক্ষ্মীটি?’
হাওয়া উত্তর দিলেন, ‘আমাদের মালিক আল্লাহ্ বলেছেন, এসব খেলে তোমরা এখান নাপাক হয়ে যাবে। তিনি তোমাদেরকে এখান থেকে বের করে দেবেন।’ শয়তান বললো: ‘উনি সত্য বলেন নি। তোমাদের অবশ্য জানা উচিৎ, আল্লাহ্ ভীষণ বদ ও ঈর্ষা পরায়ন। এজন্য তিনি কোননো প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করেন না বরং চান সবাই যেনো তার দাস হয়ে থাকে। তাই তিনি তোমাদের এরূপ বলেছেন। যেনো তোমরা তার সমান না হয়ে যাও। কিন্তু তুমি ও তোমার স্বামী সঙ্গী যদি আমার পরামর্শ নাও এবং অন্যান্য ফলমূলের সঙ্গে এগুলি খেয়ে নাও, তাহলে তোমরাও অমরত্ব লাভ করে আল্লাহর সমকক্ষ হয়ে যাবে।’
“হাওয়া তখন সেই ফলগুলি সংগ্রহ করে ভক্ষণ করলেন এবং তার স্বামী জাগ্রত হলে তাকে সব কথা জানালেন। আদম সব শুনলেন এবং তার স্ত্রী সেগুলি হাতে তুলে দিলে তিনিও সেগুলি ভক্ষণ করলেন। সহসা ফলগুলি গিলতে গিলতে স্মরণ হয় আল্লাহর বাণীর কথা। তৎক্ষণাৎ টুটি চেপে সেগুলি উগরাতে চেষ্টা করলেন। কণ্ঠমণিরূপে সেই প্রবল টুটি চাপার চিহ্ন মানুষের গলদেশে আজও বিদ্যমান।
“এ সময় উভয়েই জানতে পারলেন যে, তারা উলঙ্গ হয়ে গেছেন। যেকারণে লজ্জাতুর হয়ে ডুমুর পাতার আবরণে শরমগাকে ঢেকে ফেললেন। দুপুর গড়িয়ে যাবার পর তারা আল্লাহর উপস্থিতি বোধ করলেন, যখন ঐশীআহ্বান ধ্বনিত হলো: ‘আদম তুমি কোথায়?’
“তিনি জবাব দিলেন, ‘মাবুদ! আমি আপনার হুজুর হতে নিজেকে আড়াল করছি। কারণ আমি ও আমার সঙ্গীনি আমরা উভয়েই উলঙ্গ। তাই আপনার সামনে নিজেদের উপস্থাপন করতে সংকোচবোধ করছি।’ (আফজাল চৌধুরী অনূদিত বার্নাবাসের বাইবেল)।
বার্নাবাসের বাইবেল এখানে এই তথ্য দিচ্ছে যে, সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তে আদম-হাওয়া বস্ত্রাবৃত ছিলেন। নিষিদ্ধ সেব ও গন্ধম খাবার কারণে তাদের বস্ত্রহরণ করা হয় এবং তারা সলাজ শরম ওসংকোচবোধ প্রকাশ করে নিজেদের ঢাকার চেষ্টা করেছেন। অথচ মাইকেলের বর্ণনা থেকে প্রতিভাত হয় যে, তারা মূল থেকেই উলঙ্গ ছিলেন।
তার এই ভুল তত্ত্বের উপর নির্ভর করে শিল্পে-সাহিত্যে প্রবেশ করে নতুন এক মতবাদ। নতুন এক তত্ত্ব। নগ্নতার নন্দনতত্ত্ব।
অতএব, বার্নাবাসের বাইবেলের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, নগ্নতা মূলত প্রাকৃতিকভাবে ছিলো না। এসেছে শাস্তিরূপে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার কারণে। তাই, নগ্নতা ছিলো আদিপিতা ও আদিমাতার জন্যে লজ্জার, সংকোচের, অপমানের। ফলত তারা তা ঢাকতে চেষ্টা করেছেন স্বর্গকাননের পাতার আবরণ দিয়ে।
অতএব, নগ্নতা আদিপিতা ও আদিমাতার জন্যে লজ্জা ও অপমানের হয়ে থাকলে আমাদের জন্যে কেন নয়?
লেখক: ওয়ালী রাহমান। কবি ও প্রাবন্ধিক